২০০৪ এর ২১'শে আগষ্ট বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় আওয়ামীলীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নেতাকর্মী মারা যায়, আরো ৩০০ জন আহত হয়। এই ঘটনার পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডঃ খন্দকার মোশাররফ হোসেন তাচ্ছিল্যের সাথে বলেছিলো- ‘দূর এসব কোন ঘটনাই না। সব দেশেই এমন দুই চারটা পাঁচটা ঘটনা থাকেই।’ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদাজিয়া সংসদে দাঁড়িয়েই বলেছিলো- ‘শেখ হাসিনা নিজেই ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছে’। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফর রহমান বাবর সাজিয়েছিলো নিরহ ‘জজ মিয়া’ নাটক।
এমনকি, ২০০৫ সালের ১৭'ই আগস্ট একযোগে ৬৩ জেলায় সাড়ে ৪'শ' টি স্পটে প্রায় ৫'শর অধিক বোমা হামলা চালায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। এরপর পুরো বাংলাদেশের মানুষ ঘর ছেড়েও বেরুতে ভয় পেতো। অথচ বিএনপি তখন স্বীকারই করেনি দেশে কোনো জঙ্গি আছে!
আজকের যেই বাংলাদেশকে দেখেন, এখানে যখন তখন জঙ্গি হামলার ভয় নেই; নেই বিরোধী দলের সমাবেশে বোমা মেরে একেবারে নিচিহৃ করে দেবার ঘৃণ্য বর্বরোচিত চেষ্টা।
হ্যাঁ এটা সত্যি যে- বাংলাদেশে হাজারো সমস্যা আছে, বেকারত্ব আছে; কিন্তু এতকিছু না থাকার মাঝেও এই বাংলাদেশে আজ অনেককিছুই আছে। ৪৩ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ আছে, যা পাঁচ পাঁচবার দুর্নীতিতে শীর্ষ হবার পর কেউ কল্পনাও করেনি৷ আছে নতুন সমুদ্র বন্দর, সাবমেরিন, স্যাটেলাইট, যুদ্ধ জাহাজ, নতুন আধুনিক বিমান, আছে নিজেস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু, আছে মেট্রোরেল, টানেল, এক্সপ্রেসওয়ে, হাইওয়ে, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ইত্যাদি ইত্যাদি। যা জীবনে কোনদিন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। এইযে এখন যা কিছু আছে/হচ্ছে, এসব কোনো কালেই ছিলো না।
সবচেয়ে বড় যেই জিনিসটা চোখে পড়েছে সেটা কি জানেন? বর্তমান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা নেতাদের ‘দুঃখপ্রকাশ’ করার/ব্যর্থতা স্বীকার করার অ্যাবিলিটি।
বিদ্যুৎ সমস্যায় প্রতিমন্ত্রী নাসরুল হামিদ যতবার এসে ক্ষমা চেয়েছে/দুঃখপ্রকাশ করেছে, তা সত্যিই সুন্দর রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ। আপনি বলতে পারেন- দূর একটা দেশে বিদ্যুৎ নেই আবার আসছেন মিয়া বিদ্যুৎ জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর প্রশংসা করতে?! এই অংশটুকু বলার উদ্দেশ্য- আমরা প্রায়শই ইউরোপ আমেরিকার মন্ত্রীদেরকে পার্লামেন্টে দেখি ভুলের জন্য/সেবা দিতে না পারায় দুঃখপ্রকাশ করে। এই তো কয়দিন আগেই দেখলাম, বৃটিশ মন্ত্রী জনগণকে উদ্দেশ্য করে বলছে- ‘দেখুন আমরা সকলেই জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সমস্যায় আছি। এজন্য আমি দুঃখপ্রকাশ করছি। এমতাবস্থায় দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল না করে, চেষ্টা করুন যত দ্রুত সময়ে গোসল করা যায়’! আমি নিউজের কমেন্ট বক্স চ্যাক করে দেখলাম, একজন বৃটিশ নাগরিকও তাতে হাসাহাসি বা বিরোধীতা করে গালাগাল করেনি।
দেশের দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব ডাঃ আব্দুল মোমেন বললেন-‘আমরা তো ভালোই আছি, যেনো বেহেশতে আছি’। আমরা যে বেহেস্তে নেই তা অবশ্য সত্যি। কিন্তু, যখনতখন জঙ্গি হামলা, বোমা হামলা, হরতালের নামে আগুন দিয়ে মানুষ খুনের চেয়েও কি ভালো নেই?!যাইহোক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর ভুল বুঝতে পেরে পরদিন ই বললেন- আমি দুঃখিত। এমনকি হেসেহেসে সাংবাদিকদের সঙ্গে মজা করেই বললেন- ‘আপনারা তো আমারে একেবারে খাইয়া পালাইলেন’!
এগুলো কি জানেন? এগুলো রাজনীতির সৌন্দর্য।
বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে আপনি এমপি, মন্ত্রীদের ভুলের পর হাসাহাসি, ঠাট্টা মশকরা করতে পারবেন। এমনকি, আন্দোলন, প্রতিবাদ করে দাবীও আদায় করে নিতে পারবেন। তাতেও সম্ভব না হলে, একরকম চাপ দিয়ে হলেও কৈফিয়ত আদায় করে নিতে পারবেন। যা দেশের রাজনীতির ইতিহাসে আর নেই।
আপনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে হাসাহাসি করে বলছেন- ‘দূর পা'গল। এগুলোও মন্ত্রী হয়?!’ অথচ বোমা মেরে বিরোধী দলকে নিঃস্ব করে দেয়ার চেয়ে; ভুল করে তা স্বীকার করার মতো মন্ত্রীই তো আমাদের দরকার, তাই না?এই যে আজ বাংলাদেশ সমগ্র বিশ্বে ব্যালেন্স করে রাজনীতি করে; চীনও আমাদের শত্রু না, আমেরিকা, রাশিয়া, ভারত কেউই আমাদের শত্রুতা না; তা সম্ভব হয়েছে কার দ্বারা জানেন? এই জনাব ডাঃ মোমেনের দ্বারাই। যে তুরস্ক আমাদেরকে এক ঘরে করার হুমকি দিয়েছিলো, ঐ তুরস্কই নিজেদের দেশে বঙ্গবন্ধুর নামে স্ট্যাচু/মূর্তি বানিয়েছে। যেই চায়নার সঙ্গে আমাদের কোন রাজনৈতিক সম্পর্কই ছিলো না, সেই চায়নার পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বলা নেই কওয়া নেই বাংলাদেশে চলে আসা। এই যে বাংলাদেশকে বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ দেশের পদমর্যাদায় বসানো, সেখানে এই ভদ্রলোকের অবদান অস্বীকার করার মতো নয়।
জনাব ডাঃ আব্দুল মোমেনের ভাই জনাব ডাঃ আবুল মাল আবুল মুহিতকে নিয়ে কতই না আমরা হাসাহাসি করলাম! অথচ, আজকের যেই পদ্মাসেতু দাঁড়িয়ে আছে, সেটার অর্থায়নের কৌশল তিনিই দিয়েছিলো। তাঁরই অর্থনৈতিক মডেলের বদৌলতে বাংলাদেশের আজ ৪৩ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দেখতে পারছি। অথচ, সহজ সরল প্রকৃতির হওয়ায় আমরা তাঁকে নিয়েও উপহাস করতে ছাড়িনি।
আচ্ছা সত্যিকার অর্থেই কি আমরা শিক্ষিত, মার্জিত, সরল প্রকৃতির, দুঃখপ্রকাশ করার মতো এমপি, মন্ত্রী ডিজার্ভ করি?! এমন সহজ সরল প্রকৃতির মন্ত্রী, নাকি বিরোধী দলের সমাবেশে বোমা মেরে সবাইকে উড়িয়ে দেয়ার মতো মন্ত্রী চাই আমরা?!
মন্ত্রীদের ভুলের পর হাসাহাসি, সমালোচনা ঠিকাছে, যুক্তিসঙ্গত; কারণ এতে ভুলগুলো তাঁদের গোচর হয়। কিন্তু, মন্ত্রীদের দুঃখপ্রকাশ, ব্যর্থতা স্বীকারের পরেও আমরা যেই পরিমাণ ট্রল, হাসাহাসি করি; তা কি সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ?! এতে নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যর্থতা ধামাচাপা দেওয়ার প্রবণতা নিসন্দেহে আরো বাড়বে!
আওয়ামীলীগ সরকারের বহু বিষয়ে আমার আপত্তি আছে, টাকা পাচার, দুর্নীতি, শিক্ষাখাতে অনুন্নয়ন ইত্যাদি। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের বেশ কয়টি বিষয়ে আমি সন্তুষ্ট। এর একটি হলো- আওয়ামীলীগ সরকারের সময়ে বাংলাদেশের যেকোন প্রতিবাদ ও আন্দোলনে কেউই খালি হাতে ফেরেনি। সরকার আন্দোলন মেনে নিয়েছে, ভুল স্বীকার করেছে, তো দুঃখপ্রকাশ করে তা সংশোধনের আশ্বাস দিয়েছে। অবশ্য আওয়ামীলীগের সকল নেতা ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন করলে কাউকেই আন্দোলন করতে হতো না।
এইতো গতকালও দেখলাম, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিচ্ছে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে ছিন্নমূল ও নিম্মভিত্ত মানুষের জন্যে আলাদা কিছু করা যায় কি-না; সেই প্রদক্ষেপ নিতে। অবশ্য এতেও আমার আপত্তি আছে, বাংলাদেশের সকল সমস্যা এই একজন ই দেখাশোনা করতে হয়। অনেকটা কোম্পানির এমডির মতো। অন্যান্য মন্ত্রী ও সাংসদগণ যদি সমানতালে দেশের দিকে নজর দিতো তাহলে আমাদের এতশত সমস্যাও আর থাকতো না।
একটি সভ্য, সৌহার্দপূর্ণ, সাবলীল সুন্দর রাজনীতির রাষ্ট্রে তো আমরা এমনটাই চাই- নেতারা অন্তত ভুল স্বীকার করুক, দুঃখপ্রকাশ করুক; সংশোধনের চেষ্টা করুক। ভুল, ব্যর্থতা চেপে ধরার মতো কেউ যাতে না থাকে, তারজন্য বিরোধী দলকে নিচিহৃ করে দেওয়ার মতো এই ঘৃণ্য, বর্বরোচিত রাজনীতি বাংলাদেশে আর চাই না। কোনদিনও না!
®রাজনীতির একাল সেকাল; ভুল স্বীকারের প্রবণতা।
Sabbir Al Ahmed
Delete Comment
Are you sure that you want to delete this comment ?